মতামত কলাম: প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকের পদ : মর্যাদা ও বাস্তবতা

 

শেরপুরের সময় ডেস্ক :

১.বাংলাদেশে শিক্ষার চারটি স্তর যথা প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষা। আর এই শিক্ষা স্তরের উপর ভিত্তি করে শিক্ষক শ্রেণিকেও বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায় যেমন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কলেজ শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক । বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের মধ্যে বেতন ও মর্যাদায় বেশ তফাৎ । সরকারি চাকরির স্ট্যাটাস এখন গ্রেড দিয়ে নির্ধারন করা হয় । আগে যেটা ৪ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল এখন ২০ গ্রেডে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে । পূর্বে যেটা প্রথম শ্রেণি ছিল বর্তমানে সেটা ১ম থেকে ৯ম গ্রেড এবং দ্বিতীয় শ্রেণি হলো ১০ম গ্রেড । শুধু ১০ম গ্রেডই দ্বিতীয় শ্রেণি , ১১-১৬ তম গ্রেড তৃতীয় শ্রেণির এরপর ১৭-২০ তম গ্রেড হলো সর্বশেষ চতুর্থ শ্রেণি। পুলিশের এসআই পদ দ্বিতীয় শ্রেণির এবং প্রাইমারি/প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকের পদ দ্বিতীয় শ্রেণির। সরকারি হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষকের পদ দ্বিতীয় শ্রেণির। প্রাইমারি সহকারী শিক্ষকের পদ তৃতীয় শ্রেণির। সকল বিভাগের অফিস সহকারী, কম্পিউটার অপারেটর, ষাট মুদ্রাক্ষরিক, ড্রাইভার – এসব পদ তৃতীয় শ্রেণির। চাকরির দায়িত্বে ভিন্নতা এবং প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় সকল পদের গুরুত্ব রয়েছে। এখানে এই পদ গুলির শ্রেনী উল্লেখ করা হলো চাকুরিতে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের পদ-মর্যাদা বোঝানোর জন্য।

২.শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হলে প্রাথমিক শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কারণ এই প্রাথমিক শিক্ষাই হলো সকল শিক্ষার ভিত্তি। একটি বড় ভবন যেমন শক্ত ভিত্তি ছাড়া তৈরি করলে তা ভেঙে পড়ে, তেমনি প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি সুগঠিত না হলে পরবর্তী শিক্ষাও মজবুত হয় না। তাই প্রাথমিক শিক্ষায় অধিক মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করার পাশাপাশি প্রয়োজন প্রাথমিক শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়ন। গাছের গোড়ায় পানি না দিয়ে আগায় পানি দিয়ে গাছকে যেমন কখনো পরিপূর্ণ করে গড়ে উঠানো যায়না না, তেমনি প্রাথমিকের শিক্ষকদের যথাযোগ্য মূল্যায়ন না করে কখনো মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। শিশুদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে আর সেটি যাদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় তাঁরা হলেন আমাদের প্রাথমিকের শিক্ষক। অভিভাবক মাত্রই জানেন শিশুদের পড়ানো কত কষ্টের। আর সীমাহীন কষ্টের সেই কাজটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে করে যাচ্ছেন প্রাথমিকের শিক্ষকগণ। এই শিক্ষকগণই আমাদের শিশুদেরকে পরম মমতায় নিজের সন্তানের মতো করে আদর আর স্নেহের সাথে শিক্ষা দেন। একই সাথে সীমিত সুযোগ আর অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে শিশুদেরকে ভবিষ্যতের পরিপূর্ণ মানুষ হবার ভিত্তি গড়ে দেন। প্রকৃতপক্ষে এই শিক্ষকদেরই বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর বা শিক্ষাগুরু। আর এই শিক্ষাগুরুদের জীবনমানের উন্নয়ন না ঘটিয়ে শিক্ষার ভিত্তি বলে পরিচিত প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন বোধ করি অসম্ভব।

৩. প্রাথমিকের শিক্ষকদের সাথে কথা বললে আর তাঁদের সাথে মেলামেশা করলে বোঝা যায় কতোটা সহজ আর সাধারণ এই মানুষগুলো। তাঁদের প্রজ্ঞা আর মেধায় কোনো ঘাটতি নেই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক যে শুধু শিক্ষকতাই করেন বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। তাঁদের শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্য কাজও করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ/যেমন, জরিপের কাজ করা, ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করা, বিভিন্ন ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা, জীবনের ঝুকি নিয়ে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা, বিভিন্ন ধরনের শুমারিতে সহযোগিতা করা, মেরামত এবং সংস্কার কাজ দেখাশুনা করা, বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ এবং কখনো কখনো দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন বিরোধের মীমাংসা করা। এগুলোর বাইরেও আরো অনেক কাজ আছে যা তাঁদেরকে করতে হয়। শিক্ষকতার পাশাপাশি সরকারী দায়িত্ব এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশসেবায় প্রাথমিকের শিক্ষকগণ অন্য কোনো পেশাজীবিদের থেকে কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই। কিন্তু খবরের কাগজে প্রাথমিকের শিক্ষকদের দুর্দশার খবর আমাদের পীড়া দেয়। প্রাথমিকের শিক্ষকদের অপমানের খবরও পত্রিকায় পাওয়া যায়। প্রাথমিকের শিক্ষকগণ কোনো দাবী জানাতে জড়ো হলে তাদের উপর জলকামান থেকে শুরু করে লাঠিপেটা পর্যন্ত করা হয়। তাঁদের শরীর থেকে রক্ত ঝরতে দেখলে আমরা অসহায় বোধ করি। শিক্ষার্থী হিসেবে শিক্ষকদের এই দৃশ্য দেখে কোনোভাবেই চোখের পানি আড়াল করতে পারি না। কোনোভাবেই কাউকে আমরা দেখাতে পারি না শিক্ষকদের রক্তঝরা দুর্দশায় আমাদের হৃদয় থেকে কি পরিমাণ রক্ত ক্ষরণ হয়।

৪. প্রাথমিকের শিক্ষকদের শিক্ষার্থী হিসেবেই আজ আমাদের মধ্যে অনেকেই নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত। কেউ আর্থিকভাবে, কেউ সামাজিকভাবে আবার কেউবা পদ মর্যাদায় উচ্চ আসনে আসীন। আমাদের সকলের এই প্রতিষ্ঠিত হবার এবং সফলতার পেছনে সবচেয়ে বেশী অবদান কিন্তু এই প্রাথমিকের শিক্ষকদের। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা কেউ তাঁদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে দেখা করতে গেলে পরম যত্নে বুকে টেনে নেন। শিক্ষার্থীদের সাফল্যের খবর শুনে খুশী হন এবং আনন্দে শিক্ষকদের চোখে অশ্রু নেমে আসে। নিজে শিক্ষক বলে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারি বিষয়টা। আমাদের কোনো শিক্ষার্থীর কোনো খুশীর খবর যখন শুনি তখন ভীষনভাবে গর্বিত হই। আনন্দে চোখটা ভিজে ভারী হয়ে আসে। শিক্ষকদের ঋন কখনো শোধ করা সম্ভব নয়। ঋন শোধ করা হয়তো সম্ভব নয় তবে প্রাথমিকের শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ।

৫. শিক্ষকদের জীবনে প্রাপ্তি বলতে দুটি যথা সম্মান আর সম্মানী । সম্মান তাঁদের অন্তরকে পরিতৃপ্ত করে আর সম্মানী দিয়ে জীবন যাপন করে। সময়ের পরিক্রমায় প্রাথমিকের শিক্ষকদের জন্য দুটির কোনোটিই যথেষ্ট নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে অপমান, অভাব আর বেদনাই তাঁদের সম্বল হয়ে দাড়িয়েছে। অন্যের সাথে তুলনা না করেও বলা যায় প্রাথমিকের শিক্ষকদের যে বেতন তাতে সম্মান বজায় রাখা তো অনেক দূরের, জীবন বাচানো ও কঠিন। প্রাথমিকের শিক্ষকদের মর্যাদা তৃতীয় শ্রেনী থেকে অধিকতর সম্মানজনক শ্রেণীতে উন্নীত করে এবং সম্মান জনক বেতন কাঠামো দিয়ে শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানী বৃদ্ধি করা জরুরী । শিক্ষকদের বেতন এবং পদ মর্যাদা বৃদ্ধি হলে কেউ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে রাস্তায় নেমে পড়বে বলে মনে হয় না। প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে কেউ যদি বিরোধিতা করে তবে বুঝতে হবে সে অশিক্ষানুরাগী এবং একই সাথে কোনো শিক্ষকের শিক্ষার্থী হবার অযোগ্য। সরকার যদি প্রাথমিকের শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানী বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়ে বাস্তবায়িত করেন তবে প্রাথমিকের হাজার হাজার শিক্ষকগণ মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারবেন। প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি পেলে তাঁদের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের সাথে পুরো দেশবাসীও খুশী হবেন। সেই খুশীর আনন্দে যদি প্রাথমিকের শিক্ষকদের, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের এবং তাঁদের হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের সবার চোখে অশ্রু আসে সেটা কেউ আটকানোর চেষ্টাতো করবেই না বরং আনন্দে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দেবে যাতে প্রাথমিকের শিক্ষকদের প্রতি অযত্ন এবং অবহেলার কারণে সবার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়। তেমনটি ঘটলে জাতি হিসেবেও আমরা যেমন প্রাথমিকের শিক্ষকদের ঋন কিছুটা হলেও শোধ করার সুযোগ পাবো ।

লেখক: সেলিনা আক্তার, প্রধান শিক্ষক, খরমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শেরপুর।

  • Related Posts

    শেরপুরে র‌্যাব-১৪’র অভিযানে হত্যা মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি গ্রেপ্তার

    নিজস্ব প্রতিনিধি:  র‌্যাব-১৪, সিপিসি-১, জামালপুরের বিশেষ অভিযানে হত্যা মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি মো. সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ মাস্টার (৪৫) গ্রেপ্তার হয়েছেন। শনিবার রাতে শেরপুর সদর উপজেলার চৌধুরীপাড়া এলাকা থেকে তাকে আটক…

    শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে পাহাড়ি ঢলের পানিতে নিখোঁজ কিশোরের লাশ উদ্ধার

    দেবাশীষ সাহা রায়, শেরপুর শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশি নদীতে পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভেসে আসা কাঠগাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ মো. ইসমাইল হোসেন (১৭) নামের এক কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। শুক্রবার…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    তাজা খবর:-

    শেরপুরে জামায়াতের এমপি প্রার্থী হাফেজ রাশেদুল ইসলামের পথসভা

    শেরপুরে জামায়াতের এমপি প্রার্থী হাফেজ রাশেদুল ইসলামের পথসভা

    শেরপুরে জেলা মাসিক রাজস্ব সভা অনুষ্ঠিত

    শেরপুরে জেলা মাসিক রাজস্ব সভা অনুষ্ঠিত

    ময়মনসিংহ রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজির শেরপুর সদর কোর্ট পরিদর্শন

    ময়মনসিংহ রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজির শেরপুর সদর কোর্ট পরিদর্শন

    শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে তিন দিনব্যাপী ওয়ানগালা উৎসব শুরু

    শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে তিন দিনব্যাপী ওয়ানগালা উৎসব শুরু

    শেরপুরে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দরিদ্র মানুষকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ প্রদান

    শেরপুরে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দরিদ্র মানুষকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ প্রদান

    শেরপুরের গারো পাহাড়ের জঙ্গলে অর্ধগলিত নারীর মরদেহ উদ্ধার

    শেরপুরের গারো পাহাড়ের জঙ্গলে অর্ধগলিত নারীর মরদেহ উদ্ধার

    দুঃখিত কপি করা যাবে না! ⚠️