
‘এক সময়ের দুখিনী মায়ের সন্তান’ খ্যাত টানা পাঁচবারের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদে দুইবারের হুইপ বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আতিউর রহমান দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আতিউর ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ছানুয়ার হোসেনের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন।
নির্বাচন শেষে রোববার রাতে রিটার্নিং অফিসার আব্দুল্লাহ আল খায়রুম স্বতন্ত্র প্রার্থী ছানুয়ার হোসেনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনে ছানুয়ার পেয়েছেন ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯৩ ভোট। আর আতিউর রহমান পেয়েছেন ৯৩ হাজার ৩৭ ভোট। দুজনের ভোটের ব্যবধান ৪৩ হাজার ৫৬ ভোট।
নির্বাচনের মাঠে আতিউর এই প্রথম পরাজয়ের স্বাদ নিলেন। তবে তাঁর পরাজয়ের পেছনে শেরপুরের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন না হওয়া, আত্মঅহংকার, দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মূল্যায়ন না করা ও দলের অভ্যন্তরে বিভক্তিসহ পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় কাজ করেছে বলে দলের নেতারা মনে করছেন।
আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন ও জেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা আওয়ামী লীগের ভেতরে হুইপ আতিউর বিরোধী একটি শক্তিশালী পক্ষ গড়ে ওঠে। এর প্রত্যক্ষ প্রতিফলন ঘটে ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী চন্দন কুমার পাল ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হুমায়ুন কবীর রুমানের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ ও ২০২৪ সালের দ্বাদশ
সংসদ নির্বাচনে শেরপুর-১ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে মাঠে নামেন জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ছানুয়ার হোসেন। কিন্তু দুই নির্বাচনেই ছানুয়ার দলীয় মনোনয়ন পাননি। ফলে দীর্ঘ আট বছর ধরে শেরপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আতিউর রহমানের সঙ্গে দলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছানুয়ার হোসেনের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আতিউর ও ছানুয়ারের পক্ষ নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ছানুয়ার হোসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আতিউর রহমানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় আতিউরের বিজয়ের পক্ষে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ান ছানুয়ার।
স্বতন্ত্র প্রার্থী ছানুয়ারের পক্ষ নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নামেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর রুমান, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শামছুন্নাহার কামাল, সদর উপজলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, শেরপুর পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্মসাধারণ সম্পাদক গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়াসহ
দলের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী। অপরদিকে দলের অপেক্ষাকৃত কয়েকজন তরুণ নেতা আতিউরের পক্ষ নিয়ে প্রচারণায় অংশ নেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ফকির আখতারুজ্জামান বলেন, দীর্ঘ পাঁচবারের এমপি ও দুইবারের হুইপ আতিউর রহমান জেলা সদরের কোন উন্নয়ন করতে পারেননি, কিন্তু নিজের উন্নয়ন করেছেন।
এক সময় তিনি (আতিউর) নিজেকে দুখিনী মায়ের সন্তান বলে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি নিয়েছেন। কিন্তু এখন মানুষ তাঁর বাড়ি-গাড়ি, সহায়-সম্পদের সব খবর জানে। আতিউরের আত্মঅহংকার, দলের নেতৃস্থানীয় জ্যেষ্ঠ নেতাদের মূল্যায়ন না করা, তাঁর (আতিউর) স্ত্রী কর্তৃক প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়োগ-বদলীর বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করা এবং তাঁর চিকিৎসক মেয়ে সরকারি চাকরিজীবী হয়েও আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশে অংশ নেওয়া ও কর্তৃত্ব করার বিষয়টি জনগণ ভালোভাবে নেননি। সর্বোপরি এলাকার মানুষ পরিবর্তন ও শেরপুরের উন্নয়ন চেয়েছেন। তাই জনগণ ভোটের মাধ্যমে আতিউরকে প্রত্যাখান এবং নতুন এমপি নির্বাচিত করেছেন। আশা করা যায়, নবনির্বাচিত এমপি ছানুয়ার জনগণের কাছে শেরপুরের উন্নয়নের জন্য যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা তিনি পূরণ করবেন।
নির্বাচনে আতিউরের পরাজয়ের বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি জেলা আওয়ামী লীগের জেষ্ঠ সহসভাপতি ও আতিউরের নির্বাচন পরিচালনা পরিষদের আহবায়ক চন্দন কুমার পাল।