নকলায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মৃত কৃষিশ্রমিক ফিরোজ মিয়ার স্ত্রীর আহাজারি: এখন আমার সংসার চলবো কেমনে?

 

দেবাশীষ সাহা রায়, বিশেষ প্রতিনিধি:

‘খেত থাইক্যা কাজ কইরা ভালা মানুষটা বাড়িতে আইলো। কিন্তু ভাইস্তা বউরে বাঁচাইতে যাইয়া কারেন্টের তারে লাইগা ভাইস্তা বউয়ের সঙ্গে নিজেও মইরা গেল। তিনজনের সংসারে উপার্জন করার আর কেউ নাই। এখন আমার সংসার চলবো কেমনে?’


শেরপুরের নকলা উপজেলার টালকী ইউনিয়নের বিবিরচর মজিদবাড়ী গ্রামে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়া ফিরোজ মিয়ার স্ত্রী রূপালী বেগম গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এভাবেই আহাজারি করে করে এসব কথা বলছিলেন। এই ঘটনায় ফিরোজ মিয়ার ভাতিজা বউ পারভীন আক্তারও মারা যান। আহত হয় ফিরোজের ছেলে রোকন। গত বুধবার সন্ধ্যায় উপজেলার বিবিরচর মজিদবাড়ী গ্রামে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।মৃত ফিরোজ মিয়া মজিদবাড়ী গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে। আর গৃহবধূ পারভীন আক্তার মাসুদ মিয়ার স্ত্রী।

বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিনে জেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের নকলা উপজেলার বিবিরচর মজিদবাড়ী গ্রামের ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়,
বিদুৎস্পৃষ্টে আকস্মিকভাবে দুইজনের মৃত্যুর ঘটনায় পুরো গ্রামটিতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বাড়িতে চলছে স্বজনদের শোকের মাতম।

মৃত ফিরোজ মিয়া ও পারভীন আক্তারের পারিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফিরোজ মিয়া পেশায় কৃষি শ্রমিক ছিলেন। সারাদিন খেতে-খামারে কাজ করে যা মজুরী পেতেন তা দিয়েই সংসার চালাতেন। বাড়িভিটার জায়গা ছাড়া তাঁর কোন কৃষিজমি নেই। ফিরোজ মিয়ার দুই ছেলে। বড় ছেলে রোকন টালকী ইউনিয়নের নয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির আর ছোট ছেলে খোকন প্রভাতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র।

স্বামী ফিরোজ মিয়ার মৃত্যুতে অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সদ্য বিধবা স্ত্রী রূপালী বেগম। বলেন, তাঁরা অত্যন্ত গরীব। কোনো জমিজমা নেই। এখন সংসার কীভাবে চালাবেন তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন।
অপরদিকে মৃত পারভীন আক্তারের স্বামী মাসুদ মিয়া বলেন, তিনিও পেশায় একজন কৃষি শ্রমিক। তাঁর তিন মেয়ে। বড় মেয়ে মীম আক্তারকে বিয়ে দিয়েছেন। মেজ মেয়ে মারিয়া আক্তার স্থানীয় প্রভাতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে। আর ছোট মেয়ে মিমিয়া আক্তারের বয়স মাত্র তিন বছর।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাসুদ বলেন, ‘ঘটনার সময় আমিতো বাড়িতে ছিলাম না। ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম। সংবাদ পাইয়া বাড়িতে ছুইটা আসি। দেখি সব শ্যাষ। আমি সারাদিন খেত-খামারে কাজ করতাম। পারভীনই সংসার আর পোলাপানগরে দেখতো। এখন আমার মেয়েগরে দেখবে কে?’ স্ত্রী বিয়োগে মাসুদের কান্নায় উপস্থিত স্বজনদের চোখ জলে ভিজে যায়।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিবিরচর মজিদবাড়ী গ্রামে অন্তত. ২০টি বাড়িতে অপরিকল্পিতভাবে পল্লীতে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। একটি খুঁটি থেকেই
৮-১০টি ঘরে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। সংযোগ দেওয়া তারগুলো অগোছালো অবস্থায় রয়েছে। কোনো কোনো ঘরের টিনের চালের সঙ্গে বৈদ্যুতিক তার জড়িয়ে আছে। মৃত পারভীন আক্তারের ঘরে বিদ্যুতের যে খুঁটি থেকে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছে সেটি সিমেন্টের নয়, কাঠের। পুরো খুঁটিটি বাঁশের ঝাড়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।

বিবিরচর মজিদবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মালেক, এরশাদ আলী, এইচএসসি পরীক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তারসহ একাধিক গ্রামবাসী অভিযোগ করে বলেন, বুধবার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুইজনের মৃত্যুর ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা নয়। চার দিন আগে ঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত তারগুলো সঠিকভাবে মেরামত করে দেওয়ার জন্য তাঁরা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাঠকর্মীদের একাধিকবার অনুরোধ করেন। কিন্তু তাঁরা সেটি করেননি। ফলে বুধবার বিকেলে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ বিবিরচর মজিদবাড়ী গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করার সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চালন লাইনের একটি তার গৃহবধূ পারভীন আক্তারের শরীরে ছিঁড়ে পড়ে। এতে পারভীনের শরীর ঝলসে যায়। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে তাঁর চাচা শ্বশুর ফিরোজ মিয়াও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন এবং দুজনেই মারা যান। এই ঘটনার জন্য পল্লী বিদ্যুৎ
কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ী করেন এলাকাবাসী।
মৃত পারভীন আক্তারের স্বামী মাসুদ মিয়া বলেন, অবহেলায় আর কেউ যাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ না হারান তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানান তিনি।

জানতে চাইলে নকলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. মতিউর রহমান বলেন, বিদ্যুৎস্পৃষ্টে দুইজনের মৃত্যুর ঘটনাটি অনাকাঙ্ক্ষিত। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুতের খুঁটি ও তার মেরামতের পরই বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হয়েছিল। তথাপি ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্য ওই এলাকার বিদ্যুতের খুঁটি ও তার মেরামত করে
দেওয়া হবে। পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় বিদ্যুতের ঝুঁকির বিষয়ে গ্রাহকদের আরও সচেতন করা হবে।

নকলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল কাদের মিয়া বলেন, এঘটনায় থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। পরিবারের আবেদনক্রমে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মৃত দুজনের লাশ দাফন করা হয়েছে।

  • Related Posts

    নকলায় পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু

    শেরপুর জেলার নকলা উপজেলাতে পুকুরের পানিতে ডুবে মালহা নামে প্রায় ৪ বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ৩ জুন মঙ্গলবার সকালে নকলা উপজেলার টালকী ইউনিয়নের বাজিতবাড়ী এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। মালহা…

    নকলায় দুই ফার্মেসি মালিককে ২০ হাজার টাকা জরিমানা

    শেরপুর জেলার নকলা উপজেলায় মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষুধের দোকানে বিক্রির উদ্দেশ্যে মজুত রাখার অপরাধে দুই ফার্মেসি মালিককে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ২৮ এপ্রিল সোমবার রাত সারে ৮টার দিকে পৌর শহরের…

    One thought on “নকলায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মৃত কৃষিশ্রমিক ফিরোজ মিয়ার স্ত্রীর আহাজারি: এখন আমার সংসার চলবো কেমনে?

    1. ভালো প্রতিবেদন। এই অসহায় পরিবার দুটিকে সহায়তা করার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি।

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    তাজা খবর:-

    শেরপুরে তারেক রহমানের ৩১ দফা রূপরেখা বাস্তবায়নের প্রচারণায় র‌্যালি-সমাবেশ

    শেরপুরে তারেক রহমানের ৩১ দফা রূপরেখা বাস্তবায়নের প্রচারণায় র‌্যালি-সমাবেশ

    শেরপুরে ঝড়ের তান্ডবে অসহায় বিধবা মহিলার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত

    শেরপুরে ঝড়ের তান্ডবে অসহায় বিধবা মহিলার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত

    নালিতাবাড়ীতে বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হয়ে শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু

    নালিতাবাড়ীতে বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হয়ে শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু

    নালিতাবাড়ীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শিশুর মৃত্যু

    নালিতাবাড়ীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শিশুর মৃত্যু

    শেরপুরে জেলা বিএনপির নবগঠিত আহবায়ক কমিটির আনন্দ মিছিল অনুষ্ঠিত

    শেরপুরে জেলা বিএনপির নবগঠিত আহবায়ক কমিটির আনন্দ মিছিল অনুষ্ঠিত

    শেরপুরে জামায়াতে ইসলামীর আয়োজনে ঈদ পূর্ণমিলনী অনুষ্ঠিত

    শেরপুরে জামায়াতে ইসলামীর আয়োজনে ঈদ পূর্ণমিলনী অনুষ্ঠিত

    দুঃখিত কপি করা যাবে না! ⚠️